ছবি সংগৃহীত

দেবব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা :

“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।।”

সে সময়ে বাংলায় বিলিতি কাপর ত্যাগ করার আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণামূলক গান ছিল রজনীকান্ত সেন এর রচিতএই গানটি। সাংবাদিক জলধর সেনের বর্ণনায় পাওয়া যায় গানটি একেবারেই তাৎক্ষণিক রচনা করেছিলেনরজনীকান্ত। তার বেশিরভাগ গানই তাৎক্ষণিক রচিত। অসম্ভব প্রতিভাবান স্বভাব কবি, সুরকার, গায়ক এই মানুষটি ধীরে ধীরে বর্তমানে বিস্তৃতির অতলে চলে যাওয়ার উপক্রম। এমনকি বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমাতে তাঁর পৈত্রিক বসতবাড়ি আজ তাঁরই নাতনি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন এর জন্মভিটে হিসেবে বেশি পরিচিত। অথচ রজনীকান্ত সেন তৎকালীন ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন। অন্যরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন। আরাধনামূলক এবং দেশাত্মবোধক সঙ্গীত এর স্রষ্টা এই কবির চর্চা বর্তমান প্রজন্মের কাছে নেই বললেই চলে। ২৬ জুলাই, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন কবি ।পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত । শিশু বয়সে তিনি যথেষ্ট দুরন্ত ছিলেন এবং ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। তার লেখা থেকে পাওয়া যায় তাঁকে খুব বেশিখন পড়াশোনা নিয়ে সময় ব্যয় করতে হতো না। অসাধারন স্মৃতিশক্তির কারনে খুব অল্প সময়ে তিনি আয়ত্ত করে নিতেন পঠন পাঠন। ছাত্র হিসেবে তিনি যথেষ্ট যশস্বী ছিলেন এবং একাধিকবার বৃত্তি পান। বাবা মায়ের গান রচনার ক্ষমতা তাঁকে সংগীত জগতের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। পরিবারের ওপর হঠাৎ নেমে আসা এক অকল্পনীয় দুঃসময় তার ওপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব বর্তায়। সেই সময় তিনি বিএল পাশ করে তাদের পারিবারিক ব্যবসা ওকালতিতে নামেন। কিন্তু ওকালতির প্রতি তার কোন ঝোঁক ছিল না। তিনি সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। সংগীত ও সাহিত্য জগতে তার বহু অনুগামী থাকলেও ওকালতি ব্যবসায় তেমন পসার লাভ করতে পারেননি। কান্ত কবি রজনী কান্ত সেনের জীবনে স্বাধীনতা যে কতটা গুরুত্ব রাখত তা তাঁর এই কবিতা থেকে উপলব্ধি করতে পারি।

“বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।
বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”

তিনি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গান রচনা করেছিলেন। তাঁর গানগুলিকে মূলত বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে – দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান, হাস্যরসের গান। এর মধ্যে রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক। তবে তাঁর ভক্তিমূলক গানের ও বিশাল সম্ভার মানুষকে আপ্লুত করে। তাঁর জীবন দশায় তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো – বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫), অমৃত (১৯১০)। তার পরলোকগমনের -পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছিল আরো পাঁচটি বই। অভয়া(১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), শেষদান (১৯১৬)। অতি অল্প বয়স থেকেই বারংবার স্বজনহারা হয়েছেন তিনি। এমনকি হয়েছেন সন্তানহারাও । কিন্তু তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাস চিরকাল অটল ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে গলায় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে প্রচন্ড কষ্টের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধকারী এই কবির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × three =