ছবি সংগৃহীত

দেবব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা:

‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ / পচস্বাপতসু নারীনাং পতিরন্যো বিধায়তে
— পরাশর সংহিতা থেকে নেওয়া এই শ্লোকের অর্থ—–

স্বামী নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করলে কিংবা নপুংসক বা পতিত হলে স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন। এই ছিল বিদ্যাসাগরের মোক্ষম অস্ত্র, যার বিরুদ্ধে তেমনভাবে কোন যুক্তি বা প্রমাণ কিছুই দাঁড় করাতে পারেনি তৎকালীন হিন্দু সমাজের বিধবা বিবাহ বিরোধী জনমত। ১৭৭৬ শকাব্দ ফাল্গুন মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এবং একই নামে ১৮৫৫ সালে জানুয়ারি মাসে তার প্রথম পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। তাঁর এই বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত পুস্তিকা সমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায় প্রথম মুদ্রিত ২০০০ কপি সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আরো ১০ হাজার কপি ছাপানো হয় এবং তা অতি দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যায়। উক্ত সময়ে প্রচুর বাদানুবাদ ও কবিতা মাধ্যমে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এই বিষয়ে চর্চা চলতে থাকে। অপরদিকে এই পুস্তিকার প্রবল বিরোধিতা করে গোরা পণ্ডিতেরা কয়েকখানি পুস্তিকা প্রচার করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, রামতনু তর্ক সিদ্ধান্ত, গঙ্গাধর কবিরাজ, মহেশচন্দ্র চূড়ামণি, শ্রীরাম তর্কালঙ্কার, ঈশানচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ,গোবিন্দ বিদ্যাভূষণ, জগদীশ্বর বিদ্যারত্ন ,রামদাস তর্ক সিদ্ধান্ত, নন্দকুমার কবিরত্ন, আনন্দ শিরোমণি, হারাধন কবিরাজ, রামদয়াল তর্করত্ন ইত্যাদি। কিন্তু বিদ্যাসাগর পরাজয় মেনে নেওয়ার মানুষ ছিলেন না। তাঁর মত দৃঢ়চেতা মানুষ সত্যিই বিরল। বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে,- “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।” ইংরেজ ধর্মের গোঁড়ামিতে আঘাত দিতে একেবারেই প্রস্তুত নয় বুঝে, দিনরাত এক করে পরাশর সংহিতা থেকে বের করলেন প্রয়োজনীয় বিধি সম্বলিত শ্লোক। সেই শ্লোকের জোরেই প্রমাণিত হলো হিন্দু শাস্ত্রে বহু আগে থেকেই বিধবা বিবাহ অনুমতি সুস্পষ্টভাবে দেওয়া আছে।
এরপর আইন পাস হতে আর কোন বাধা রইলো না। বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই এর মাধ্যমে ১৮৫৫ সালের ছাব্বিশে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কষ্ট তাকে ভীষণ ভাবে স্পর্ষ করত। দৃঢ়চেতা এই মরমী মানুষটি তৎকালীন বাংলায় নারীজাতির নিপীড়নের বিরুদ্ধে একের পর এক লড়াই লড়ে গেছেন। তিনি ছিলেন মাতৃভক্ত। তাঁর মা তাঁকে জনদরদি ভূমিকা পালনে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন। মাতৃ আজ্ঞাতেই তিনি গ্রামের সকলকে শাল বিতরণ করেছিলেন। শিশুপাঠ্য রচনা, স্ত্রীশিক্ষার প্রচার ও প্রসার, শিক্ষার প্রসারে স্কুল কলেজ স্থাপন, তৎকালীন পরাধীন ভারতের বুকে শুধুমাত্র দেশীয় শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বিরুদ্ধে সংগ্রাম ইত্যাদি বহুবিধ পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ছিলেন। তৎকালীন সময়ে আজকের মত পেনশন বা অ্যানুইটি বলে কোন বার্ধক্য ভাতা দেওয়ার প্রচলন ছিল না। মানুষের দুঃখ কষ্টের নিবারন করার জন্য, একটি নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন বিদ্যাসাগর। শুরু করলেন “ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড” ১৮৭২ সালের ১৫ ই জুন বিদ্যাসাগর মহাশয় তৈরি করেন হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড। বাঙালি হিন্দু পরিবারে সাধারণত একজনের উপার্জনের ওপর নির্ভর করত। কোন কারণে তার মৃত্যু হলে পরিবারের স্ত্রী-পুত্র অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সকলে অসহায় হয়ে যেত । এই পরিবারে জীবনের খানিকটা নিরাপত্তার জন্য বিদ্যাসাগর অ্যানুইটি প্রতিষ্ঠা করেন । যিনি মাসে মাসে কিছু টাকা দেবেন এবং মৃত্যুর পর স্ত্রী পুত্র অন্যান্য আত্মীয় সেই টাকার দ্বিগুনের কিছু বেশি যাবৎজীবন মাসিক সাহায্য পাবেন । এই সাহায্যের পরিমাণ ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত হত। প্রথমে ১০ জন গ্রাহক নিয়ে ৩২ নম্বর কলেজস্ট্রিটে ফান্ডের কাজ আরম্ভ হয়। পাইকপাড়ার রাজারা একত্রে ২৫০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। পৃথিবীর বুকে জীবন বীমা এবং বার্ধক্য ভাতা দুটোই তখন এক বিরল ধারণা। ভারতবর্ষে এই ধারণার পথিকৃৎ স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়। বিদ্যাসাগরের মহানুভবতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও বছর তিনেক আগের করণা আবহে ভীষণ সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বিষয় উল্লেখ করি। তখন করোনা আবহে পাড়ায় পাড়ায় দানছত্র দেখা গেছে। অনেকক্ষেত্রেই মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় খাদ্য ইত্যাদি গ্রহণ করেছেন। পরে বিভিন্ন লেখালেখিতে দেখা গেল একশ্রেণীর মানুষ, যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত , তারা নিরন্ন থাকলেও লজ্জায় সেখান থেকে দান নিতে পারেননি। বিদ্যাসাগর যে অন্নছত্র খুলেছিলেন, সেখানে দুস্থ মানুষের খাদ্যের, বস্ত্র এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা করেছিলেন। তথাপি যারা সংকোচের কারণে সেখানে আসতে পারতেন না, তাদের গৃহে গোপনে অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতেন তিনি। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষায় অসামান্য প্রতিভার কারণে হয়েছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ ,মানুষের কাছে ছিলেন দয়ার সাগর। আজ থেকে ২০৩ বছর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় এবং মা ভগবতী দেবীর ঘর আলো করে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

four × five =